জোয়ার ভাটা (TIDES )

প্রশ্ন (১) জোয়ার ভাটা (TIDES ) কাকে বলে? 

উত্তর -জোয়ার-ভাটা (Tides) :চন্দ্র সূর্যের আকর্ষণে   সাগর-মহাসাগর কিংবা নদীর জল কখনো ফুলে ওঠে বা স্ফীত  হয় ,  আবার কখনো জল  নিচে নেমে যায়। জলরাশির এই ফুলে ওঠা এবং নিচে নেমে যাওয়ার প্রাকৃতিক ঘটনাকে জোয়ার-ভাটা বলে।

প্রশ্ন (২) জোয়ার ভাটা সৃষ্টির কারণ লিখ। 

জোয়ার-ভাটা সৃষ্টির কারণ (Causes of Tides) : প্রধানত দুটি কারণে ভূ-পৃষ্ঠে জোয়ার ভাটা সৃষ্টি হয়। যথা- (ক) চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ (খ) পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে সৃষ্ট বিকর্ষণ বা কেন্দ্র বহির্মুখী শক্তি

(ক) চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ

 চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণে পৃথিবীর জলরাশি সহজেই ফুলে ওঠে বা স্ফীত হয়।চন্দ্র অপেক্ষা সূর্য বহুগুণ বড় ও ভারী হওয়া সত্ত্বেও জোয়ার ভাটা সৃষ্টির ক্ষেত্রে চন্দ্রের আকর্ষণ অধিক কার্যকরী । কারণ চন্দ্র সূর্য অপেক্ষা পৃথিবীর অনেক কাছে অবস্থিত। পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি কি.মি.। কিন্তু পৃথিবী থেকে চন্দ্রের দূরত্ব মাত্র চার লক্ষ কি.মি.।

(খ) বিকর্ষণ বা কেন্দ্র বহির্মুখী শক্তি : পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে যেমন কেন্দ্রমুখী শক্তি উৎপন্ন হয়, তেমনি আবার কেন্দ্র বহির্মুখী বা বিকর্ষণ শক্তির সৃষ্টি হয়। এ বিকর্ষণ শক্তির প্রভাবে পৃথিবীর প্রতিটি অণু মহাকর্ষ শক্তির বিপরীতদিকে ছিটকে যায়। ফলে আকর্ষণ শক্তির প্রভাবে একদিকে যেমন মুখ্য জোয়ার সৃষ্টি হয় ঠিক তার বিপরীত পার্শ্বে বিকর্ষণ শক্তির প্রভাবে গৌণ জোয়ার উৎপন্ন হয়।

প্রশ্ন (৩)চন্দ্র জোয়ার ও সৌর জোয়ার কাকে বলে? 

উত্তর ● চান্দ্র জোয়ার ও সৌর জোয়ার : যে জোয়ার চন্দ্রের আকর্ষণে হয়, তাকে চান্দ্র জোয়ার বলে। সূর্যের আকর্ষণে যে জোয়ার হয়, তাকে সৌর জোয়ার বলে।

প্রশ্ন (৪) মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ার কাকে বলে? 

● মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ার : আবর্তনরত পৃথিবীর যে অংশ চন্দ্রের সামনে আসে, সেই অংশে চন্দ্রের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি বা মহাকর্ষশক্তির প্রভাবে যে জোয়ার উৎপন্ন হয়, তাকে মুখ্য জোয়ার বলে। আবার মুখ্য জোয়ারের বিপরীত পার্শ্বে অর্থাৎ প্রতিপাদস্থানে পৃথিবীর বিকর্ষণশক্তির প্রভাবে যে জোয়ার সৃষ্টি হয়, তাকে গৌণ জোয়ার বলে।

● ভাটা : মুখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ারের ঠিক সমকোণে অবস্থিত স্থানগুলিতে জল কিছুটা নেমে যায় অর্থাৎ ভাটার সৃষ্টি হয়।

প্রশ্ন (৫)ভরা জোয়ার কাকে বলে? 

উত্তর• ভরা জোয়ার বা তেজ কটাল (Spring tide) : অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে পৃথিবী চন্দ্র এবং সূর্য একই সরলরেখায় অবস্থান করে। ফলে জোয়ারের মাত্রা প্রবল হয়। এই প্রবল জোয়ারকে ভরা জোয়ার বা তেজ কটাল বলে। তবে পূর্ণিমার জোয়ার অপেক্ষা অমাবস্যার জোয়ার অধিক প্রবল। কারণ এই দিনে সূর্য ও চন্দ্র একই দিকে অবস্থান করে।

প্রশ্ন (৫)মরা জোয়ার কাকে বলে?

উত্তর • মরা জোয়ার বা মরা কটাল (Neap Tide ) : শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে সমকোণে অবস্থান করে। ফলে চন্দ্র ও সূর্যের আকর্ষণ পরস্পর বিরোধী হওয়ার জন্য এই দিনগুলিতে জোয়ারের প্রাবল্য কম থাকে। একে মরা জোয়ার বা মরা কটাল বলে।

প্রশ্ন (৫) সিজিগি  বা যোগবিন্দু কি? 

উত্তর • সিজিগি বা যোগবিন্দু : চন্দ্র, সূর্য ও পৃথিবীর একই সরলরেখায় অবস্থানকে সিজিগি বলে। 

প্রশ্ন (৬)সংযোগ  ও প্রতিযোগ অবস্থান কাকে বলে? 

উত্তর -অমাবস্যার সময় সূর্য ও পৃথিবীর মাঝখানে চন্দ্র অবস্থান করে। একে সংযোগ অবস্থান বলে। পূর্ণিমার সময় সূর্য ও পৃথিবীর পরে চন্দ্র অবস্থান করে। একে প্রতিযোগ অবস্থান বলে।

প্রশ্ন (৭)●অ্যাপোজি ও পেরিজি (Apogee and perigee) কাকে বলে? 

 অ্যাপোজি  (Apogee ) -চন্দ্র যখন পৃথিবী পরিক্রমণ করে তখন পৃথিবী থেকে চন্দ্রের দূরত্ব সব সময় সমান থাকে না। চন্দ্র পৃথিবী থেকে যখন সবচেয়ে দূরে থাকে, (প্রায় ৪ লক্ষ ৭ হাজার কি.মি.) তখন  তাকে চন্দ্রের অ্যাপোজি অবস্থান বলে। এই সময় চন্দ্রকে ছোট দেখায়। একে মাইক্রো মুন  (micro moon) বলে। অ্যাপোজি অবস্থায় জোয়ারের প্রাবল্য কম। 

পেরিজি(perigee)–চন্দ্র যখন পৃথিবী থেকে সবচেয়ে নিকটে থাকে (প্রায় ৩ লক্ষ ৫৬ হাজার কি.মি.) তখন তাকে চন্দ্রের পেরিজি  অবস্থান বলে। এই সময় চাঁদকে বড় এবং উজ্জ্বল  দেখায়। একে সুপার মুন (Super moon) বলে।  পেরিজি অবস্থানে জোয়ারের মাত্রা বেশি । 

প্রশ্ন (৮)জোয়ার ভাটার ব্যবধান লিখ ।

উত্তর• জোয়ার-ভাটার ব্যবধান : দুটি মুখ্য  ও  দুটি গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিঃ। মূখ্য জোয়ার ও গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান ১২ ঘণ্টা ২৬ মিঃ অর্থাৎ কোনো স্থানে ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিটের মধ্যে ২ বার জোয়ার (মূখ্য ও গৌণ) ও ২ বার ভাটা হয়। কোনো স্থানে জোয়ার ও ভাটার মধ্যে সময়ের ব্যবধান ৬ ঘণ্টা ১৩ মিনিট।

প্রশ্ন (৯) • কোন স্থানে একই সময়ে জোয়ার ভাটা না হওয়ার কারণ কি?

উত্তর :পৃথিবীকে পরিক্রমণ করতে চন্দ্রের মোট সময় লাগে ২৭ দিন। পৃথিবী যখন ২৪ ঘণ্টায় নিজের চারদিকে একবার ঘোরে তখন চাঁদ পৃথিবীর কক্ষপথের ৩৬০ / ২৭ = ১৩° পথ অতিক্রম করে। এই ১৩° পথ অতিক্রম করতে পৃথিবীর সময় লাগে ১৩ × ৪ = ৫২মিনিট। তাই পৃথিবীর যে কোন স্থান ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পরে একবার করে চাঁদের সামনে আসে। তাই প্রতিটি মূখ্য বা গৌণ জোয়ার ২৪ ঘণ্টা ৫২ মিনিট পরে সংঘটিত  হয়।

প্রশ্ন(১০) বান ডাকা কি ?

• বান ডাকা (Tidal Bore) : ভরা জোয়ারের সময় সমুদ্রের জল স্ফীত হয়ে প্রবল বেগে মোহনার মধ্য দিয়ে নদীতে প্রবেশ করে এবং প্রবলবেগে জল উঁচু হয়ে উপরের দিকে এগিয়ে যায় ও নদীতে জলোচ্ছ্বাস ঘটায় । একে বান ডাকা বলে।ভাগীরথী -হুগলি,ইয়াংসিকিয়াং ও টেমস  নদীতে   বাণ ডাকার  সৃষ্টি হয়। 

বান ডাকার কারণ : কতকগুলি কারনে নদীতে বান খুব প্রবল হয়। যেমন

i) ভরা জোয়ারের   সময় সমুদ্রে প্রবল জোয়ারের প্রভাবে 

ii) নদীর মোহানায় বালির চড়া সৃষ্টি হলে  

iii) সারাবছর নদীতে জলের পরিমাণ যদি বেশি থাকে  

iv) নদীর মুখ যদি ফানেল আকৃতির হয়, নদীখাত যদি অপেক্ষাকৃত সংকীর্ণ হয়,

 vi) নদীর জলস্রোত প্রবল হলে, 

vil) জোয়ারের জল প্রবেশের সময় নদীর স্রোতে বা অন্যভাবে বাধা পেলে।

প্রশ্ন(১০)ষাঁড়াষাঁড়ির বান কাকে বলে? 

উত্তর -ষাঁড়াষাঁড়ির বান : দুটি ষাঁড়ে লড়াই করার সময় যেমন গর্জন করে, ঠিক তেমনি টেম্স, আমাজন, ইয়াং-সিকিয়াং, ভাগীরথী প্রভৃতি নদীতে যখন বান আসে তখন জলের উচ্চতা ৭-৮ মিটার উঁচু হয় এবং প্রবল গর্জন শুনতে পাওয়া যায়। তাই একে ষাঁড়াষাঁড়ির বান বলে। এখানে দুটি ষাঁড় হল একটি সমুদ্রের জোয়ারের উজানগামি  জল এবং অপরটি নদীর নিম্নগামী জল। 

প্রশ্ন(১১) জোয়ার ভাটার প্রভাব লেখ ।

উত্তর• জোয়ার ভাটার প্রভাব (Influence of Tide) : (১)  জোয়ার-ভাটার ফলে নদীর জল পরিষ্কার ও স্বচ্ছ থাকে। কারণ ভাটার টানে নদী আবর্জনামুক্ত হয়। 

(২) নদী মোহনাতে পলি জমা হতে পারে না। নদী নৌচলাচলের উপযুক্ত হয়ে ওঠে। 

(৩) জোয়ারের জলের মাধ্যমে নদীতে প্রচুর সামুদ্রিক মাছ ঢুকে পড়ে। ফলে মৎস্যজীবিরা খুবই উপকৃত হয়।

 (৪) বর্তমানে জোয়ারের জলকে কাজে লাগিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে।

(৫) জোয়ারের সময় নদীতে জলের পরিমাণ বেড়ে যায়। ফলে বড় বড় জাহাজ সহজেই নদীতে প্রবেশ করতে পারে।

 (৬) সমুদ্রের লবণাক্ত জল জোয়ারের সময় নদীতে প্রবেশ

করে বলে নদীর জলও কিছুটা লবণাক্ত হয়ে পড়ে। ফলে নদীর জল শীতকালে জমে না।

(৭) নদীতে যখন বান দেখা দেয় তখন জলযান (নৌকা, লঞ্চ, স্টীমার ইত্যাদি) ডুবে যাবার সম্ভাবনা থাকে।

 (৮) উপকূলভাগ জোয়ার ভাটার ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।

 (৯) প্রবল জোয়ার ব-দ্বীপ গঠনের প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে।

 (১০) কিছু কিছু নদী সর্বদা জোয়ারের প্রবল জলে পুষ্ট থাকে। যেমন – সুন্দরবনের নদ-নদী।

…. অনুশীলনী

•১। অতি-সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন (জ্ঞানমূলক ও বোধমূলক)

(ক) জোয়ার ভাটা খেলে এমন একটি নদীর নাম লেখ। 

উত্তর -ভাগীরথী -হুগলি 

(খ) দুটি মুখ্য জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত?

উত্তর- 24 ঘন্টা 52 মিনিট 

(গ) দুটি গৌণ জোয়ারের মধ্যে সময়ের ব্যবধান কত? 

উত্তর- 24 ঘন্টা 52 মিনিট

(ঘ) দিনে কবার জোয়ার ভাটা হয়? 

উত্তর -দুবার জোয়ার দুবার ভাটা হয়

(ঙ) সিজিগি বলতে কি বোঝ? 

উত্তর চন্দ্র’ সূর্য ‘পৃথিবী যখন একই সরলরেখায় অবস্থান করে তখন তাকে সিজিগি  বলে। 

(চ) কোন তিথিতে মরা কটাল হয়? 

উত্তর -কৃষ্ণ শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে 

(ছ) কোন্ তিথিতে ভরা জোয়ার দেখা যায়? 

উত্তর -অমাবস্যা পূর্ণিমা তিথিতে 

(জ) পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব কত?

উত্তর 4 লক্ষ কিলোমিটার 

(ঝ) জোয়ার ভাটা সৃষ্টিতে কোন্ জ্যোতিষ্কের প্রভাব বেশি?

উত্তর- চাঁদের প্রভাব বেশি। 

ট)একটি মুখ্য একটি গৌণ জোয়ারের ব্যবধান কত? 

উত্তর -12 ঘন্টা 26 মিনিট 

ঠ) জোয়ার ভাটার ব্যবধান কত? 

উত্তর -6 ঘন্টা 13 মিনিট। 

●২। সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন  : প্রশ্নের মান -২ 

(ক) জোয়ার-ভাটা কাকে বলে? 

(খ) মুখ্য জোয়ার কাকে বলে? 

(গ)গৌণজোয়ার বলতে কি বোঝ?

(ঘ) ভরা জোয়ার কাকে বলে?

ঙ) বান ডাকে কেন?

(চ) মরা জোয়ার কাকে বলে?

৩)ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণধর্মী প্রশ্ন ঃ প্রশ্নের মান- ৩ 

(ক) প্রতিদিন একই সময়ে জোয়ার ভাটা হয় না কেন? 

খ) বান ডাকে কেন?

গ) অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে জোয়ারের প্রাবল্যতা বেশি কেন? 

ঘ) অষ্টমীতে   তিথিতে জোয়ারের প্রাবল্যতা কম কেন?

ঙ) ভরা জোয়ার ও মরা জোয়ারের পার্থক্য লিখ।

৪। রচনাধর্মী প্রশ্ন  : প্রশ্নের মান -৫

(ক) জোয়ার-ভাটার কারণগুলি আলোচনা কর। 

(খ) জোয়ার ভাটার ফলাফল উল্লেখ কর  কর। 

(গ) অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে কিভাবে জোয়ার ভাটা সৃষ্টি হয়?

Leave a Comment