হিমবাহের কাজ(Works of glacier):

হিমবাহ (Glacier): বায়ুর উষ্ণতা হিমাঙ্কের (0° সেঃ) নিচে নেমে গেলে জলীয়বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তুষারকণায় পরিণত হয়। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তুষারকণা থেকে সৃষ্ট বরফের পিন্ড অত্যন্ত ধীরগতিতে ভূমির ঢাল বরাবর নিচের দিকে নেমে আসে। এরূপ ধীরগতি সম্পন্ন চলমান বিশাল বরফের স্তূপকে হিমবাহ বলে। হিমবাহ প্রকৃতপক্ষে বরফের নদী। উদাহরণ গঙ্গোত্রী, বলটারো, সিয়াচেন, হুবার্ড।

• হিমরেখা (snowline): যে কাল্পনিক সীমারেখার উপরে জল বরফে পরিণত হয় তাকে হিমরেখা বলে। হিমরেখার উচ্চতা সর্বত্র সমান নয়। মেরু অঞ্চলে হিমরেখা সমুদ্র সমতলে, নিরক্ষরেখায় ৫৫০০ মিটার উচ্চতায়, হিমালয়ে ৪০০০ মিটার উচ্চতায় এবং আল্পস পর্বতে ২৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে।

নুনাটক্‌স্ (Nunataks): মহাদেশীয় হিমবাহ অঞ্চলের বরফমুক্ত পর্বত শিখরকে নুনাটক্স বলে। যেমন- অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট তাকাহি।

• হিমশৈল (Ice berg): সমুদ্রজলে পাহাড়প্রমাণ ভাসমান বরফ স্তূপকে হিমশৈল বলে। হিমশৈলের আঘাতে জাহাজ ডুবে যায়। হিমশৈল আবার মগ্নচড়া সৃষ্টি করে।

• হিমসোপান (ice shelf): উপকূলরেখা অতিক্রম করে ভাসমান হিমবাহের যে অংশ সমুদ্রের উপর এগিয়ে আসে, সেই অংশকে হিমসোপান বলে। রস আইস শ্রেফ পৃথিবীর বৃহত্তম হিমসোপান।

• হিমবাহের ক্ষয়জাত ভূমিরূপ (Erosional landforms)• (ক) সার্ক বা করি (Cirque or corrie): উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহের অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট ডেকচেয়ারের ন্যায় গর্তকে ফরাসী ভাষায় সার্ক, ইংরাজী ভাষায় করি এবং জার্মান ভাষায় কার বলে।

• (খ) সার্ক বা করি হ্রদ (Corrie lake): অনেক সময় সার্কের মধ্যে ছোট ছোট হিমবাহ টুকরো থেকে যায়। হিমবাহ গলে গিয়ে সার্কের মধ্যে জল জমা হয়ে যে হ্রদের সৃষ্টি হয়, তাকে সার্ক হ্রদ বা করি হ্রদ বলে।

• (গ) এরিটি (Arete): পাশাপাশি দুটি সার্কের মধ্যবর্তী অংশটি উঁচু হয়ে শৈল শিরার ন্যায় অবস্থান করে। একে এরিটি বা হিমশিরা বলে।

• (গ) এরিটি (Arete): পাশাপাশি দুটি সার্কের মধ্যবর্তী অংশটি উঁচু হয়ে শৈল শিরার ন্যায় অবস্থান করে। একে এরিটি বা হিমশিরা বলে।

 

•(ঘ)পিরামিড চূড়া (pyramidal peak): পাশাপাশি তিন-চারটি সার্ক গঠিত হলে তাদের মাঝের অংশটিপিরামিডের ন্যায় উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একে পিরামিড চূড়া বলে। যেমন- আল্পসের ম্যাটার হর্ণ, হিমালয়ের শিবলিঙ্গ, নীলকণ্ঠ ইত্যাদি।                                      

 • (ঙ) হিমদ্রোণী বা U-আকৃতির উপত্যকা (U-shaped Valley): হিমবাহের অবঘর্ষ দ্বারা V-আকৃতির নদীর উপত্যকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে U- আকৃতির উপত্যকায় পরিণত হয়। একে হিমদ্রোণী বা হিমখাত বা হিমবাহ উপত্যকা বলে। হিমদ্রোণীর তলদেশ চওড়া ও মসৃণ এবং পার্শ্বদেশ খাড়া ঢালযুক্ত হয়। অনেক সময় হিমদ্রোণীর মাঝে হিমবাহ গলে হ্রদের সৃষ্টি করে। যেমন রূপকুণ্ড।

   • (চ) ঝুলন্ত উপত্যকা (Hanging Valley): প্রধান হিমবাহের দু-পাশ থেকে ছোট ছোট উপ হিমবাহ এসে মিলিত হয়। প্রধান হিমবাহের ক্ষয়শক্তি বেশি থাকায় উপত্যকাটি খুব গভীর হয়। তাই মনে হয়, উপ-হিমবাহ উপত্যকাগুলি প্রধান হিমবাহ উপত্যকার উপর ঝুলছে। একে ঝুলন্ত উপত্যকা বলে। ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত (waterfalls) সৃষ্টি 

• (ছ) ক্র্যাগ ও টেল (Crag and Tail): হিমবাহের গতিপথে কোন কঠিন শিলার পিছনে কোমল শিলা থাকলে কঠিন শিলা কোমল শিলাকে ক্ষয়কাজের হাত থেকে রক্ষা করে। এর ফলে কঠিন শিলা উঁচু ঢিপির আকার ধারণ করে, একে ব্র্যাগ বলে। ক্র্যাগের পিছনের কোমলশিলা সরু লেজের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই একে পুচ্ছ বা টেল বলা হয়।

• (জ) রসে মতানে (Roche-moutone): হিমবাহের গতিপথে কোন কঠি শিলা উঁচু ঢিপির আকারে অবস্থান করে থাকলে হিমবাহের অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা শিলাখন্ডটির একদিক (হিমবাহের প্রবাহের দিক) মসৃণ এবং বিপরীত পার্শ্ব এবড়েখেবড়ো বা অমসৃণ হয়। এরূপ শিলাখন্ডকে রসেমতানে বলে।

• (ঝ) ফিয়োর্ড (Fiord): উপকূলবর্তী অঞ্চলে হিমবাহ দ্বারা সৃষ্ট উপত্যকা অনেক সময় সমুদ্র-পৃষ্ঠ অপেক্ষা গভীর হয়। এর ফলে উপত্যকা জলমগ্ন হয়ে যায়। একে ফিয়োর্ড বলে। নরওয়ের সোভনে পৃথিবীর গভীরতম ফিয়োর্ড।

  

 • (ক) গ্রাবরেখা (Moraine): হিমবাহ দ্বারা বাহিত দ্রব্যসমূহ (নুড়ি, বালি, কাঁকর, কাদা ইত্যাদি) উপত্যকার বিভিন্ন অংশে স্তূপাকারে জমা হতে থাকে। এদের গ্রাবরেখা বলে। গ্রাবরেখা নানা ধরনের হয়। যথা-

(i) পার্শ্ব গ্রাবরেখা (Lateral moraine): হিমবাহের দু-পাশে এই গ্রাবরেখা অবস্থান করে। (ii) মধ্যগ্রাবরে খা (Medial moraine): দুটি হিমবাহের মাঝখানে দেখা যায়। (iii) প্রান্ত গ্রাবরেখা (Terminal): হিমবাহ যেখানে এসে শেষ হয় অর্থাৎ সম্পূর্ণরূপে গলে যায় সেখানে সৃষ্ট গ্রাবরেখা প্রান্ত গ্রাবরেখা নামে পরিচিত (iv) ভূমি গ্রাবরেখা (Ground moraine): এই গ্রাবরেখা হিমবাহের তলদেশে সঞ্চিত হয়। (v) অবিন্যস্ত গ্রাবরেখা (Push-pull moraine): গ্রাবরেখাগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় থাকে। (vi) বলয়িত গ্রাবরেখা (Lobate moraine) এগুলি দেখতে বৃত্তাকার। (vii) রোজেন গ্রাবরেখা (Rogen moraine): একাধিক গ্রাবরেখা এলে অপরের উপর সঞ্চিত হয়।

• (খ) বোল্ডার ক্লে বা হিমকর্দ (Boulder clay): হিমবাহ গলে যাওয়ার পা হিমবাহ বাহিত পলি, বালি, পাথর, নুড়ি, কাদা প্রভৃতি একসঙ্গে সঞ্চিত হয়ে আস্তরণের সৃষ্টি হয় তাকে হিমকর্দ বা বোল্ডার ক্লে বলে।

• (গ) ড্রামলিন (Drumlin): ব্লোডার ক্লে অঞ্চলে হিমবাহ-বাহিত নুড়ি, বাি পাথরখণ্ড ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে যদি উল্টানো নৌকা বা চামচের মত ভূমিরূপ গঠন কল তবে তাকে ড্রামলিন বলে। একই স্থানে অজস্র ড্রামলিন অবস্থান করে থাকলে থেকে সেগুলিকে ডিমের ঝুড়ি (Basket of the Eggs) মনে হয়।

• (ঘ) এসকার (Eskar) : হিমবাহ-বাহিত নুড়ি, বালি, কাঁকর প্রভৃতি সঞ্চয়ের ফলে আঁকাবাঁকা শৈলশিরার ন্যায় ভূমিরূপ গঠিত হলে তাকে এসকার বলে। 

• (ঙ) আগামূক (Irratics) : হিমবাহ বাহিত পদার্থগুলির মধ্যে বৃহৎ-আকৃতির শিলাখণ্ড কোথাও সঞ্চিত হলে তাদের আগামুক বলে।

• (চ) কেম (kame) : হিমবাহের শেষপ্রান্তে যখন হিমবাহ গলতে শুরু করে তখন হিমবাহের মধ্যে থাকা নুড়ি, পাথর, কাঁকর, কাদা ইত্যাদি সঞ্চিত হয়ে ত্রি-কোণাকার ব-দ্বীপের ন্যায় ভূমিরূপ গঠন করলে তাকে কেম বলে।

 

(ছ) বহিঃধৌত সমভূমি (outwash plain): পর্বতের পাদদেশে হিমবাহ বাহিত নুড়ি বালি কাঁকর প্রভৃতি একত্রে জমা হয়ে যে সমভূমি গঠন করে তাকে বহিঃধৌত সমভূমি বলে।

বার্গস্রুন্ড (Bergschrund): পর্বতগাত্র ও প্রবহমান হিমবাহের মধ্যে সৃষ্ট ফাঁককে বার্গস্রুন্ড বলে।

• স্নাউট (Snout): গতিশীল হিমবাহের মধ্যভাগ খুব তাড়াতাড়ি অগ্রসহ হওয়ায় এর সম্মুখভাগ অনেকটা জিহ্বার মত দেখতে হয়। একে স্লাউট বলে।

• ক্রিভাস (Crevas): টানের ফলে হিমবাহের গায়ে সৃষ্ট ফাটলকে ক্রিভাস বলে।

Leave a Comment