■ বায়ুর কাজ (Works of winds) ■
বায়ুর কাজ (Works of winds) Class-10
বায়ু একপ্রকার প্রাকৃতিক শক্তি। প্রধানত ভূ-পৃষ্ঠের উন্মুক্ত অঞ্চলে (সমুদ্র পৃষ্ঠ ও মরু অঞ্চল) বায়ুর কার্য লক্ষ্য করা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি উষ্ণ মরু অঞ্চলেই বায়ুরকার্য প্রবল।
কারণ- (১) মরু অঞ্চল, শুষ্ক, প্রায় বৃষ্টিহীন ও গাছপালাশূন্য। ফলে বায়ু এখানে অবাধে চলাচল করতে পারে। (২) গাছপালার অভাবে মৃত্তিকা আলগা থাকে। তাই বায়ু অতি সহজেই ক্ষয় করতে পারে। (৩) দিবা-রাত্রি উষ্ণতার পার্থক্যহেতু যান্ত্রিক আবহবিকার অধিক শক্তিশালী। (৪) বালুকণা বায়ুর মূল অস্ত্র। বায়ুর সঙ্গে পরিবাহিত সূঁচালো বালুকণা ভূ-পৃষ্ঠের বিভিন্ন শিলায় অবঘর্ষ চালিয়ে নানা ধরনের • ভূমিরূপ গঠন করে।
গ্রীক্ বায়ু দেবতা ‘Aeolus’-এর নামানুসারে বায়ুর বিভিন্ন প্রকার কাজ দ্বারা গঠিত ভূমিরূপকে আয়োলিয়ান (Eeolian) ভূমিরূপ বলে।
• বায়ুর বিভিন্ন কাজ: বায়ু তিনপ্রকার কাজ করে। যথা-
• (ক) ক্ষয়কাজ (Erosion):
বায়ু অপসারণ, অবঘর্ষ ও ঘর্ষণ এই তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষয়কাজ চালিয়ে যায়। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বালুকণা বায়ুর দ্বারা একস্থান থেকে অন্যস্থানে চলে গেলে তাকে অপসারণ (deflation) ক্রিয়া বলে। বায়ুর দ্বারা পরিবাহিত শিলাখণ্ড ও বালুকণার আঘাতে মরুঅঞ্চলের শিলাস্তর ক্ষয় প্রাপ্ত হয়। একে বায়ুর অবঘর্ষ (abrasion) ক্রিয়া বলে। বায়ুতাড়িত শিলাখণ্ডগুলি পরস্পরের ঠোকাঠুকিতে ক্ষুদ্রক্ষুদ্র বালুকণায় পরিণত হয়। একে ঘর্ষণ ক্রিয়া বলা হয়।
• (খ) বহন কাজ (Transportation):
বায়ু প্রধানত ভাসমান, লম্ফদান ও গড়ান এই তিনটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বহনকাজ সম্পন্ন করে। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বালুকণাগুলি বায়ুর সঙ্গে ভাসতে ভাসতে, অপেক্ষাকৃত বড় বড় শিলাখণ্ডগুলি ভূমিভাগের সঙ্গে ঠোক্কর খেয়ে লাফাতে লাফাতে এবং বড় বড় শিলাখণ্ডগুলি গড়াতে গড়তে অগ্রসর হয়।
• (গ) সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ (deposition) :
বায়ুর দ্বারা পরিবাহিত পদার্থসমূহ পথমধ্যে কোন বাধা পেলে জমা হতে থাকে। একে বায়ুর সঞ্চয়কাজ বা অবক্ষেপণ বলে।
■বায়ুর ক্ষয়কাজ দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ

গৌর
• ভেন্টিফ্যাক্ট ও ড্রেইকান্টার (ventifact and dreikantar): বায়ুর অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা এগুলি গঠিত হয়। যেসব মরুভূমিতে একদিক থেকে বায়ু প্রবাহিত হয় সে- সকল মরুভূমির বায়ুর গতিপথে দাঁড়িয়ে থাকা প্রস্তরখন্ডের একদিক মসৃণ এবং অ
পরদিক অমসৃণ হয়। একে ভেন্টিফ্যাক্ট বলে। আবার, বিভিন্ন দিকে বায়ু প্রবাহিত মরু অঞ্চলে প্রস্তরখন্ডের বিভিন্ন দ প্রস্তরখণ্ডকে ড্রেই কান্টার বলে। আফ্রিকার কালাহারি মরুভূমিতে ভেন্টিফ্যাক্ট এবং সাহারা মরুভূমিতে ড্রেইকান্টার দৃষ্টিগোচর হয়।
• জুগেন (zuegen):
কঠিন ও কোমল শিলা যদি আড়াআড়িভাবে অবস্থান করে এবং কঠিন শিলার উপর ফাটল থাকে তবে ফাটলের মধ্য দিয়ে বায়ু ও বালুকণা প্রবেশ করে ক্ষয়কার্য চালাতে থাকে এবং কোমল শিলাস্তরে গহ্বরের সৃষ্টি করে। ফলে গহ্বরের মধ্যবর্তী অংশে কঠিন শিলাগঠিত চ্যাপ্টা ও সমতল শীর্ষদেশ বিশিষ্ট পরস্পর সমান্তরাল যে মূর্তির সৃষ্টি হয় তাদের জুগেন বলে। সোনেরান মরুভূমিতে জুগেন দেখা যায়।
• ইয়ারদাঙ (Yardang):
কঠিন ও কোমল শিলা লম্বরূপে অবস্থান করে থাকলে বায়ুর বৈষম্যমূলক ক্ষয়কার্যের ফলে (কঠিন শিলায় কম, কোমল শিলায় বেশি) কঠিন শিলাস্তরগুলি পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে উঁচু টিলারূপে দাঁড়িয়ে থাকে। এদের ইয়ারদাঙ বলে। আটাকামা ও আরব মরুভূমিতে দেখা যায়।
• ইন্ন্সেলবার্জ (Inselberg):
মরুঅঞ্চলের কঠিন ও কোমলশিলাযুক্ত এলাকায় বায়ুর অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা কোমল শিলা বেশি পরিমাণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয় এবং কঠিন শিলা সামান্য পরিমাণে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে পাহাড় বা টিলারূপে বিরাজ করে। জার্মান ভূগোলবিদ্গণ এদের ইন্ন্সেলবার্জ নামে অভিহিত করেন। কালাহারি মরুভূমিতে দেখা যায়।
• ছত্রাকশিলা বা গৌর (Gour):
মরু অঞ্চলে প্রায় ১ মিটার বা তার বেশি উঁচু দণ্ডায়মান কোন শিলাস্তম্ভের মাঝের অংশ বায়ুর অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা অধিক মাত্রায় ক্ষয় হয়ে সবু হয়ে যায়। কিন্তু উপরের ও নিচের অংশ সে তুলনায় কম ক্ষয় হয়ে বিস্তৃত বা চওড়া অবস্থায় বিরাজ করে। এটি দেখতে অনেকটা ব্যাঙের ছাতার মত। একে ছত্রাকশিলা বা গৌর বলে। সাহারা মরুভূমিতে দেখা যায়।
• ভূ-স্তম্ভ (Domisells):
কোমলশিলাযুক্ত অঞ্চলে মাঝে মঝে কঠিন শিলার আবরণ থাকলে বায়ুর অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা কোমল শিলা ক্ষয়প্রাপ্ত হয় কিন্তু কঠিন শিলা দ্বারা-আবৃত অংশ ক্ষয় থেকে রক্ষা পেয়ে ভূ-পৃষ্ঠে স্তম্ভরূপে অবস্থান করে। এদের ভূ- স্তম্ভ বলে। চীনের গোবি মরুভূমিতে দেখা যায়।
• ধান্দ (Dhand):
মরুঅঞ্চলে বায়ুর অপসারণ ক্রিয়ার দ্বারা ক্ষুদ্র বৃহৎ নানা আকৃতির গর্তের সৃষ্টি হয়। রাজস্থান মরুভূমিতে এগুলি ধান্দ নামে পরিচিত।
• মরুদ্যান (Oasis):
বায়ুর অপসারণ ক্রিয়ার দ্বারা ধান্দগুলি ক্রমশ গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে। পরিশেষে গভীরতা এত বেড়ে যায় যে, ভূ-গর্ভের জলস্তর পর্যন্ত পৌঁছে জলাশয়ের সৃষ্টি হয়। এর ফলে সেখানে গাছপালা জন্মে মরুদ্যানের আকার ধারণ করে। মরুদ্যান মরুভূমির আশ্রয়স্থল।
•
বায়ুর সঞ্চয় কার্য দ্বারা গঠিত ভূমিরূপ
বায়ুর সঞ্চয় কার্যের ফলে দুরকমের ভূমিরূপ গঠিত হয়
যথা -(১)বালিয়াড়ি (২)লোয়েস সমভূমি (Loess)
বালিয়াড়ি (sand Dunes):
বায়ুতাড়িত ধূলিকণা কোন বৃহৎ শিলাখণ্ড, গাছপালা, উঁচু ঢিপি, কিংবা ঝোপঝাড়ে ধাক্কা খেয়ে তথায় স্তূপাকারে জমা হতে থাকে। বায়ুর দ্বারা গঠিত বালির এই স্তূপকে বালিয়াড়ী বলে। বাগনোল্ড (Bagnold), উইলসন (Wilson), ম্যাকি (mackey) প্রভৃতি ভূবিজ্ঞানী বালিয়াড়িকে নানাভাবে ভাগ করেছেন।
•
(ক) মস্তক বালিয়াড়ি (Head dune) : বায়ুর গতিপথে অবস্থিত প্রতিবন্ধকের প্রতিবাত ঢালে গঠিত হয়।
• (খ) পুচ্ছ বালিয়াড়ি (Tail dune): প্রতিবন্ধকের অনুবাত ঢালে গঠিত হয়।
(গ) অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি (Advanced dune): মস্তক বালিয়াড়ির নিকটে ঘূর্ণির সৃষ্টি হলে একটু দূরে যে বালিয়াড়ি গঠিত হয়, তাকে অগ্রবর্তী বালিয়াড়ি বলে।
• (ঘ) পার্শ্ববালিয়াড়ি (Lateral dune): প্রতিবন্ধকের উভয় পার্শ্বে গঠিত হয়।
• (ঙ) তির্যক বালিয়াড়ি (Transverse dune): বায়ুর গতিপথের সঙ্গে আড়াআড়িভাবে গঠিত বালিয়াড়িকে তির্যক বালিয়াড়ি বলে।
•(চ) বারখান (Barkhan): ‘বারখান’ একটি তুর্কী শব্দ। এর অর্থ বালির পাহাড়। তির্যক বালিয়াড়িগুলির মধ্যে যেগুলি দেখতে অর্ধচন্দ্রাকার সেগুলিকে বারখান বলে। বার্খানের দু-পাশে শিং থাকে। এক একটি বার্খান ১৫-২০০ মিটার জায়গা দখল করে থাকে। এর সামনের দিকটি উত্তল (Convex) এবং এর পিছনের দিকটি অবতল (concave) আকৃতিবিশিষ্ট হয়।
• (ছ) অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি (longitudinal dune): বোয়ু প্রবাহের গতির সমান্তরালে গঠিত বালিয়াড়িকে অনুদৈর্ঘ্য বালিয়াড়ি বলে। এদের মধ্যে যে বালিয়াড়িগুলি খুব লম্বা ও সরু তাদের সিফ্ (sief) বালিয়াড়ি বলে।
•(জ) চলন্ত বালিয়াড়ি (Shifting dune): প্রবল বায়ুপ্রবাহে বালিয়াড়ি যদি স্থান পরিবর্তন করে তবে তাদের অস্থায়ী বা চলন্ত বালিয়াড়ি বলে। ভারতের রাজস্থান। মরুভূমিতে চলন্ত বালিয়াড়ি ধ্রিয়ান নামে পরিচিত।
•(ঝ) রোডস বালিয়াড়ি (Roads dune): এগুলি দেখতে পিরামিডের মত।
•(ঞ) আকলে বালিয়াড়ি (Akle dune): আঁকাবাঁকা সাপের মত দেখতে বালিয়াড়িকে আকলে বালিয়াড়ি বলে।
• (২) লোয়েস সমভূমি (Loess):
জার্মান শব্দ ‘লোয়েস’ কথাটির অর্থ সূক্ষ্ম পলি বা স্থানচ্যুত বস্তু। প্রবল বাতাসের প্রভাবে মরু অঞ্চলের সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম বালুকণা অপসারিত হয়ে দূরবর্তী কোন অঞ্চলে জমা হয়ে যে সমভূমির সৃষ্টি করে তাকে লোয়েস সমভূমি বলে। যেমন- গোবি মরুভূমির হলুদ রঙের লোয়েস মৃত্তিকা চীনের হোয়াংহো নদী অববাহিকায় বৃহত্তম লোয়েস মরুভূমি গঠন করেছে।
• মরু অঞ্চলের বায়ু ও জলধারার মিলিত ক্রিয়া:
মরু অঞ্চলে আকস্মিক বৃষ্টিপাতের জন্য উচ্চভূমি থেকে অসংখ্য জলধারা পাথরের টুকরো, নুড়ি, কাঁকর, সূক্ষ্ম শিলাচূর্ণ সঙ্গে নিয়ে প্রবলবেগে নিচের দিকে নেমে আসে। ফলে জলের কাজের দ্বারা নানারকম ভূমিরূপ গঠিত হয়। যেমন ওয়াদি, পেডিমেন্ট, বাজাদা, প্লায়া ইত্যাদি।
• ওয়াদি (Wadi):
জলধারার সঙ্গে নুড়ি, বালি, কাঁকর, কাদা ইত্যাদি পরিবাহিত হয়ে কর্দম ধারার (Mudflow) সৃষ্টি করে। কর্দমধারার প্রবাহ হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে মরুভূমিতে যে নদীখাতের সৃষ্টি হয় তাকে ওয়াদি বলে।
• পেডিমেন্ট (Pediment):
‘পেডিমেন্ট’ কথার অর্থ পর্বতের পাদদেশ। মরু অঞ্চলে বায়ু ও জলধারার মিলিত কার্যের ফলে পর্বতের পাদদেশে যে সমভূমি গঠিত হয়, তাকে পেডিমেন্ট বলে।
• বাজাদা (Bazada):
মরুঅঞ্চলে পেডিমেন্টের নিচে, নুড়ি, কাঁকর, বালি প্রভৃতি দীর্ঘকাল ধরে স্তরে স্তরে জমা হয়ে যে সমভূমি গঠন করে, তাকে বাজাদা বলে।
• প্লায়া (playa):
মরু মধ্যস্থিত পার্বত্য অঞ্চল থেকে বেরিয়ে আসা ছোট ছোট নদী বা জলধারা কোন নিচু অংশে জমা হয়ে যে লবণাক্ত হ্রদের সৃষ্টি করে, তাকে প্লায়া বলে।