১)হিমবাহ কাকে বলে?
হিমবাহ (Glacier) : বায়ুর উষ্ণতা হিমাঙ্কের (° সেঃ) নিচে নেমে গেলে জলীয়-বাষ্প ঘনীভূত হয়ে তুষারকণায়
পরিণত হয়।মাধ্যাকর্ষণ শক্তির টানে তুষারকণা থেকে সৃষ্ট বরফের পিন্ড অত্যন্ত ধীরগতিতে ভূমির ঢাল বরাবর নিচের দিকে নেমে আসে। এরূপ ধীরগতিসম্পন্ন চলমান বিশাল বরফের স্তূপকে হিমবাহ বলে। হিমবাহ প্রকৃত পক্ষে বরফের নদী ।
উদাহরণ–গঙ্গোত্রী,বলটারো, সিয়াচেন, হুবার্ড ইত্যাদি ।
২)হিমরেখা বলতে কী বোঝো।
হিমরেখা (snowline) যে কাল্পনিক সীমারেখার উপরে জল বরফে পরিণত হয় তাকে হিমরেখা বলে। হিমরেখার উচ্চতা সর্বত্র সমান নয় মেরু অঞ্চলে হিমরেখা সমুদ্র সমতলে নিরক্ষ-রেখায় ৫৫০০ মিটার উচ্চতায়, হিমালয়ে৪০০০ মিটার উচ্চতায় এবং আল্পস পর্বতে ২৭০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থান করছে।
৩) হিমাবাহ কয় প্রকার ও কি কি?
হিমবাহের শ্রেণিবিভাগ :(Classification of glacier)
হিমবাহ তিনপ্রকার।
• (১) পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ –উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে উপত্যকার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হিমবাহকে পার্বত্য বা উপত্যকা হিমবাহ বলে।
উদাহরণ-হুবার্ড(পৃথিবীর বৃহত্তম), কারকোরামের সিয়াচেন (ভারতের দীর্ঘতম), গঙ্গোত্রী (হিমালয়ের দীর্ঘতম), বলটারো, যমুনোত্রী, জেমু প্রভৃতি।
• (২) পর্বতের পাদদেশীয় হিমবাহ: হিমবাহ যখন নিচে প্রবাহিত হতে হতে পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করে, তখন তাকে পাদদেশীয় হিমবাহ বলে। উদাহরণ -আলাস্কার মালাসপিনা (বৃহত্তম)।
● (৩) মহাদেশীয় হিমবাহ (Continental glacier) : উভয় মেরু অঞ্চলে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে যে বরফের স্তূপ দেখা যায়, তাকে মহাদেশীয় হিমবাহ বলে। উদাহরণ –ল্যামবার্ট (পৃথিবীর দীর্ঘতম), কুয়ারব্যাক (পৃথিবীর দ্রুততম)।
৪)হিমানী সম্প্রপাত কি?
উত্তর-হিমানী সম্প্রপাত (Avalanche) : চলমান পার্বত্য হিমবাহ ভেঙে আছাড় খেয়ে হঠাৎ নিচে পড়লে তাকে হিমানী সম্প্রপাত বলে।
৫) নুনাটকস কাকে বলে?
(Nunataks) : মহাদেশীয় হিমবাহ অঞ্চলের বরফমুক্ত পর্বত শিখরকে নুনাটক্স বলে। যেমন- অ্যান্টার্কটিকার মাউন্ট তাকাহি।
৭) হিমশৈল কি?
উত্তর-হিমশৈল (Ice berg) : সমুদ্রজলে পাহাড় প্রমাণ ভাসমান বরফ স্তূপকে হিমশৈল বলে। হিমশৈলের আঘাতে জাহাজ ডুবে যায়। হিমশৈল আবার মগ্নচড়া সৃষ্টি করে।
৮) হিমসোপান কাকে বলে?
উত্তর –হিমসোপান (ice shelf) : উপকূলরেখা অতিক্রম করে ভাসমান হিমবাহের যে অংশ সমুদ্রের উপর এগিয়ে আসে, সেই অংশকে হিমসোপান বলে। রস আইস শ্রেফ পৃথিবীর বৃহত্তম হিমসোপান।
• হিমবাহের কাজ (Works of glacier)
: হিমবাহ তিন প্রকার কাজ করে। যথা
• (১) ক্ষয়কাজ (erosion) : হিমবাহ উৎপাটন এবং অবঘর্ষ এই দুটি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ক্ষয়কাজ করে।
a)উৎপাটন (plucking) : প্রবহমান হিমবাহের চাপে পর্বতের গা থেকে শিলাখণ্ড আলাদা হয়ে গেলে তাকে উৎপাটন বলে।
b)অবঘর্ষ (Abrasion)-হিমবাহের সঙ্গে প্রবাহিত প্রস্তরখণ্ডের ঘর্ষণে হিমবাহ উপত্যকা মসৃণ হয় এবং পর্বত গাত্রে আঁচড় কাটার মত দাগ পড়ে। একে অবঘর্ষ বলে।
(২) পরিবহন কাজ (Transportation) : হিমবাহ দ্বারা ক্ষয়প্রাপ্ত পদার্থসমূহ নুড়ি, পাথর, বালি, কাদা ইত্যাদি হিমবাহের সঙ্গে অপসারিত হয়। একে হিমবাহের পরিবহন কাজ বলে।
(৩) সঞ্চয় বা অবক্ষেপণ (Deposition) : হিমবাহ দ্বারা পরিবাহিত পদার্থসমুহ প্রবাহপথের বিভিন্ন অংশে জমা হতে থাকে। একে হিমবাহের সঞ্চয় বলে।
হিমবাহের ক্ষয়জাত ভূমিরূপ
৯)হিমবাহের বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়জাত ভূমিরূপ কি কি ?
উত্তর-হিমবাহের বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়জাত ভূমিরূপগুলি হল-
১)সার্ক বা করি Cirque or corrie
২)সার্ক হ্রদ বা করি হ্রদ Cirque lake
৩)এরিটি Arete
৪)পিরামির চূড়া pyramid peak
৫)ইউ আকৃতির উপত্যকা U-shaped valley
৬)ঝুলন্ত উপত্যকা Hanging Valley
৭)ক্র্যাগ ও টেল Crag and tail
৮)রসে মতানে Roche moutane
৯) ফিয়োর্ড Fiyord
১০). হিম সিড়ি ও প্যাটার নষ্টার হ্রদ Glacier stair and paternoster lake
১০)হিমবাহের বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়জাত ভূমিরূপ আলোচনা কর ।
হিমবাহের বিভিন্ন প্রকার ক্ষয়জাতভূমিরূপগুলি হল-
১) সার্ক বা করি ও সার্ক হ্রদ- উচ্চ পার্বত্য অঞ্চলে হিমবাহ ও তার সঙ্গে পরিবাহিত বিভিন্ন প্রস্তর খন্ডের অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা হিমবাহের প্রবাহ পথে হাতওয়ালা আরাম চেয়ারের মতো যে গর্তের সৃষ্টি হয় তাকে ফরাসি ভাষায় সার্ক, ইংরেজি ভাষায় করি, জার্মান ভাষায় কার বলে। অনেক সময় সার্কের মধ্যে হিমবাহের টুকরা থাকলে সার্ক হ্রদের সৃষ্টি হয়।
বৈশিষ্ট্য -ক)সার্কের তিনটি অংশ থাকে। মধ্যভাগে খাত, মস্তকের খাড়া প্রাচীর, প্রান্ত ভাগ ঢালু। খ) সার্ক এরিটি গঠনে গঠনে সাহায্য করে।
উদাহরণ -হিমালয় ও আল্পস পর্বতে দেখা যায়।
(২) হিমদ্রোণী বা U-আকৃতির উপত্যকা (U-shaped Valley) : হিমবাহের অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা V-আকৃতির নদী উপত্যকা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে U- আকৃতির উপত্যকায় পরিণত হয়। একে হিমদ্রোণী বা হিমখাত বা হিমবাহ উপত্যকা বলে।
বৈশিষ্ট্য -ক)হিমদ্রোণীর তলদেশ চওড়া ও মসৃণ এবং পার্শ্বদেশ খাড়া ঢালযুক্ত হয়।
খ) অনেক সময় হিমদ্রোণীর মাঝে হিমবাহ গলে হ্রদের সৃষ্টি করে। যেমন -রূপকুণ্ড।
উদাহরণ– আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ইয়োসেমিতি
(৩) ক্র্যাগ ও টেল (Krag and Tail) : হিমবাহের গতিপথে কোন কঠিন শিলার পিছনে কোমল শিলা থাকলে কঠিন শিলা কোমল শিলাকে ক্ষয়কাজের হাত থেকে রক্ষা করে। এর ফলে কঠিন শিলা উঁচু ঢিপির আকার ধারণ করে, একে ক্র্যাগ বলে। ক্র্যাগের পিছনের কোমলশিলা সরু লেজের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। তাই একে পুচ্ছ বা টেল বলা হয়।
বৈশিষ্ট্য – ক)ক্র্যাগ খাড়াঢালযুক্ত এবং টেল মৃদু ঢালযুক্ত হয়। খ)এটি হিমবাহের একটি ক্ষয়জাত ভূমিরূপ।
উদাহরণ স্কটল্যান্ডের এডিনবরা ক্যাসেল
(৪) এরিটি (Arete) : পাশাপাশি দুটি সার্কের মধ্যবর্তী অংশটি উঁচু হয়ে শৈলশিরার ন্যায় অবস্থান করে। একে এরিটি বা হিমশিরা বলে।
(৫) পিরামিড চূড়া( pyramidalpeak) : পাশাপাশি তিন-চারটি সার্ক গঠিত হলে তাদের মাঝের অংশটি পিরামিডের ন্যায় উঁচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একে পিরামিড চূড়া বলে ।
যেমন—আল্পসের ম্যাটার হর্ণ, হিমালয়ের শিবলিঙ্গ,নীলকণ্ঠ ইত্যাদি।
(৬) ঝুলন্ত উপত্যকা ( Hanging Valley) : প্রধান হিমবাহের দু-পাশ থেকে ছোট ছোট উপ হিমবাহ এসে মিলিত হয়।প্রধানহিমবাহের ক্ষয় শক্তি বেশি থাকায় উপত্যকাটি খুব গভীর হয়। তাই মনে হয়, উপ-হিমবাহ উপত্যকাগুলি প্রধান হিমবাহ উপত্যকার উপর ঝুলছে। একে ঝুলন্ত উপত্যকা বলে। ঝুলন্ত উপত্যকায় জলপ্রপাত (waterfalls)সৃষ্টি হয় ।
৭) রসে মতানে (Roche-moutonee) : হিমবাহের গতিপথে কোন কঠিনশিলা উঁচু ঢিপির আকারে অবস্থান করে থাকলে হিমবাহের অবঘর্ষ ক্রিয়ার দ্বারা শিলাখণ্ডটির একদিক (হিমবাহের প্রবাহের দিক) মসৃণ এবং বিপরীত পার্শ্ব এবড়ো-খেবড়ো বা অমসৃণ হয়। এরূপ শিলাখণ্ডকে রসে মতানে বলে।
(৮) ফিয়োর্ড (Fiord): উপকূলবর্তী অঞ্চলে হিমবাহ দ্বারা সৃষ্ট উপত্যকা অনেক সময় সমুদ্র-পৃষ্ঠ অপেক্ষা গভীর হয়। এর ফলে উপত্যকা জলমগ্ন হয়ে যায়। একে ফিয়োর্ড বলে। নরওয়ের সোভনে পৃথিবীর গভীরতম ফিয়োর্ড।
(৯) হিমসিঁড়ি ও প্যাটারনস্টার হ্রদ (Glacier stair and paternoster lake) : হিমবাহের বৈষম্যমূলক ক্ষয়কার্যের ফলে পার্বত্য উপত্যকায় যে ধাপের সৃষ্টি হয়,তাকে হিমসিঁড়ি বলে। হিমসিঁড়ির ঢাল নিচের দিকে না হয়ে যদি উপরের দিকে অর্থাৎ পর্বতগাত্রের দিকে হয় তবে তাতে জল জমা হয়ে হ্রদের সৃষ্টি করে। একে প্যাটারনস্টার হ্রদ বলে।
■