Weatheringআবহবিকার

আবহবিকার (weathering)

(১) আবহবিকার (weathering) কাকে বলে?

উত্তর-আবহবিকার (Weathering)’-আবহবিকার’ কথাটি আবহাওয়া থেকে এসেছে।আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদান, (বায়ুর উষ্ণতা, আর্দ্রতা, বৃষ্টিপাত), উদ্ভিদের শিকড় এবং ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী (ইঁদুর, খরগোশ, কেঁচো ইত্যাদি) দ্বারা শিলার চূর্ণ-বিচূর্ণ হওয়াকে আবহবিকার বলে।উদাহরণ: সানসেটের ঢালাই ফেটে যাওয়া, লোহায় মরিচা ধরা, ইটে লোনা লাগা ইত্যাদি।

(২) আবহবিকারকে বিচূর্ণীভবন বলা হয় কেন?

উত্তর-আবহবিকারের দ্বারা শিলাসমূহ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে মূল শিলা থেকে আলাদা বা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তাই আবহবিকারকে বিচূর্ণীভবন বলা হয়। শিলার গঠন, ভূ-প্রকৃতি, জলবায়ু উদ্ভিদ ও প্রাণীর উপর আবহবিকার বিশেষভাবে নির্ভরশীল। যেমন— সমভূমি অঞ্চল অপেক্ষা মালভূমি অঞ্চলে আবহবিকার বেশি শক্তিশালী। আবার ক্রান্তীয় জলবায়ু অঞ্চলে আবহবিকার বেশি দেখা যায়।

(৩) ক্ষয়ীভবন ও নগ্নীভবন (Erosion and Denudation) কাকে বলে?

ক্ষয়ীভবন ও নগ্নীভবন (Erosion and Denudation) : আবহবিকার দ্বারা সংঘটিত চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির প্রভাবে (নদী, হিমবাহ, বায়ু) অপসারিত হলে তাকে ক্ষয়ীভবন বলে। আবহবিকার ও ক্ষয়ীভবন এই দুটি প্রক্রিয়াকে একত্রে নগ্নীভবন বা নির্মোচন বলে।

(৪) আবহবিকারের শ্রেণিবিভাগ কর।

উত্তর-আবহবিকারের শ্রেণিবিভাগ (Classification) : আবহবিকার তিনপ্রকার–

ক) যান্ত্রিক আবহবিকার, (খ) রাসায়নিক আবহবিকার (গ) জৈবিক আবহবিকার।

(5) যান্ত্রিক আবহবিকার (Mechanical Weathering) কাকে বলে?

উত্তর -যান্ত্রিক আবহবিকার (Mechanical Weathering) : উষ্ণতার তারতম্য, তুষার,বৃষ্টিপাত উদ্ভিদ ও প্রাণী, লবণ প্রভৃতির প্রভাবে স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক উপায়ে শিলা চূর্ণবিচূর্ণ হলে  তাকে যান্ত্রিক আবহবিকার বলে।  উদাহরণ: সানসেটের ঢালাই ফেটে যাওয়া

(৬)কোন কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয় ?

উত্তর -নিম্নলিখিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যান্ত্রিক আবহবিকার সংঘটিত হয়।

(ক) প্রস্তর চাই বিচ্ছিন্নকরণ (Block disintegration) :রুঅঞ্চলে দিনের বেলায় সূর্যের প্রচণ্ড উত্তাপে শিলা প্রসারিত হয় এবং রাত্রিবেলা তাপ বিকিরণের ফলে শিলা সংকুচিত হয়।বারংবার সংকোচন ও প্রসারণের ফলে শিলার মধ্যে প্রবল অভ্যন্তরীণ পীড়নের সৃষ্টি হয় এবং শিলাতে উল্লম্ব ও অনুভূমিক ফাটল দেখা যায়। হঠাৎ এক সময় ফাটলের মধ্যবর্তী শিলারাশি চাঁই-এর আকারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একে প্রস্তর চাঁই বিচ্ছিন্নকরণ বলে।

(খ) শল্কমোচন (Exfoliation) : শল্ক কথাটির অর্থ হল আঁশ বা ছাল। সম প্রকৃতির শিলার(একই প্রকার খনিজ দিয়ে গঠিত) উপরের স্তর ভিতরের স্তরের চেয়ে অনেক বেশি উত্তপ্ত হয়ে আয়তনে বেড়ে যায় এবং পিঁয়াজের খোসার ন্যায় ধীরে ধীরে খুলে পড়ে। একে শঙ্কমোচন বা স্তর মোচন বলে।

গ) ক্ষুদ্রকণা বিশরণ (Granular Disintegration): একাধিক খনিজ দিয়ে গঠিত শিলা অর্থাৎ বিসমসত্ত্ব শিলা উষ্ণতা কমা বাড়ার ফলে বিভিন্ন হারে সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এর ফলে প্রবল টানের সৃষ্টি হয়। শিলা একসময় বন্দুকে গুলি ছোঁড়া আওয়াজের মত শব্দ করে ফেটে যায়। এই প্রক্রিয়াকে ক্ষুদ্রকণা বিশরণ বা কণাভবন বলে। সাধারণত সূর্যাস্তের পর এরকম ঘটনা মরু অঞ্চলে লক্ষ্য করা যায়।

  • (ঘ) তুষার ক্রিয়া বা তুষারখন্ডীকরণ (Snow shattering) : উচ্চ পর্বত গাত্রে বা শীতল জলবায়ু অঞ্চলে বরফ গলা কিংবা বর্ষার জল শিলামধ্য কোন ফাটলে প্রবেশ করে। এই জল অত্যধিক ঠাণ্ডায় বরফে পরিণত হলে আয়তনে প্রায় ৯-১০ শতাংশ বেড়ে যায়।ফলে ফাটলের দেওয়ালগুলিতে চাপ পড়ে এবং শিলা ভেঙ্গে পড়ে। পর্বতের ঢাল বরাবর উপর নিচে সঞ্চিত শিলা খণ্ডগুলিকে স্ত্রী বা ট্যালাস এবং পাহাড় বা পর্বতের পাদদেশে সঞ্চিত শিলাখণ্ডকে ফেলসেনমার বা ব্লকস্পেড বলা
  • (ঙ) ময়লার সংস্পর্শেভাঙন (Dirt cracking) :শিলা মধ্যস্থিত ফাটলে সঞ্চিত ধুলা, বালি তাপে প্রসারিত হয়ে ফাটলে চাপ সৃষ্টি করে এবং একসময় ফাটল বরাবর শিলা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।
  • (চ) লবণ ক্রিয়া (Salting) : শুষ্ক মরু অঞ্চলে শিলাস্তরের ফাটলের মধ্যে সঞ্চিত লবণ কেলাস ফাটলে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে আবহবিকার ঘটায়।

(ছ)কলয়েড উৎপাটন (Colloid plucking) : কলয়েড মৃত্তিকার এমন উপাদান যা জৈব ও খনিজের সমন্বয়ে গঠিত। এই আঁঠালো পদার্থ শুকিয়ে গেলে শিলাস্তরের কিছু অংশ খসে পড়ে।

  • (জ) জৈব প্রক্রিয়া (Biotic process) : উদ্ভিদের শিকড় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণী যান্ত্রিক আবহবিকারে সাহায্য করে।

(৭) রাসায়নিক আবহবিকার (Chemical weathering) কাকে বলে?

উত্তর- রাসায়নিক আবহবিকার (Chemical weathering) অক্সিজেন, কার্বনডাই অক্সাইড,জলীয় বাষ্প প্রভৃতির দ্বারা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় শিলা চুর্ণ-বিচূর্ণ হলে তাকে রাসায়নিক আবহবিকার বলে। উদাহরণ লোহায় মরিচা ধরা,

(৮) রাসায়নিক আবহবিকারের বিভিন্ন ( different process of chemical weathering)পদ্ধতিগুলি লিখ।

উত্তর- রাসায়নিক আবহবিকার এর বিভিন্ন পদ্ধতিগুলো হল

(১) জারণ (Oxidation): লৌহ মিশ্রিত শিলায় অক্সিজেনের বিক্রিয়া ঘটলে শিলায় মরচে পড়ে করে পড়ে এবং শিলা ক্রমাগত ক্ষয় প্রাপ্ত হয়ে ধূলায় পরিণত হয়। অক্সিডেশান প্রক্রিয়ায় শিলার আসল রঙ বদলে দিয়ে লাল, বাদামি ও হলুদ রঙে পরিণত হয়।

(২) অঙ্গার বা কার্বোনেশান (Carbonation): বৃষ্টির জলের সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড মিশলে কার্বোনিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। কার্বোনিক অ্যাসিড মিশ্রিত জল চুনাপাথর ও ডলোমাইট এলাকায় রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে শিলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে।

  • (৩) জলযোজন (Hydration) শিলা মধ্যস্থিত খনিজের সঙ্গে বিশুদ্ধ জল যুক্ত হলে খনিজটি রাসায়নিক বিক্রিয়ায় ফুলে ওঠে এবং আয়তনে বেড়ে যায়। ফলে খনিজের অনুগুলির সংবদ্ধতা নষ্ট হয়ে যায় এবং খনিজটি বিয়োজিত হয়ে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়। জলযোজনে হেমাটাইট আকরিক লৌহ লিমোনাইটে পরিণত হয়।  হেমাটাইট + জল = লিমোইট
  • (8) দ্রবণ (Solution) : সৈন্ধব লবণ, জিপসাম, প্রভৃতি জলের সংস্পর্শে এসে সম্পূর্ণ গলে শিলার রাসায়নিক গঠনে পরিবর্তন ঘটায়।

(১০) জৈব আবহবিকার (Biological weathering) কাকে বলে?

উত্তর-উদ্ভিদ ও ছোট ছোট প্রাণী দ্বারা সংঘটিত আবহবিকারকে জৈব বা জৈবিক আবহবিকার বলে। এই আবহবিকার দু-প্রকারের — (ক) জৈব যান্ত্রিক (খ) জৈব রাসায়নিক। জৈব যান্ত্রিক উদ্ভিদের শেঁকড় শিলাস্তরের ফাটলে প্রবেশকরে ফাটল বরাবর শিলাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে মূল শিলাস্তর থেকে আলাদা করে দেয়। তাছাড়া খরগোশ, ছুঁচো, ইঁদুর, প্রেইরী, কুকুর প্রভৃতি প্রাণী এবং নানারকম কীট-পতঙ্গ শিলার উপর গর্ত খুঁড়ে আবহবিকার ঘটায়।

(খ) জৈব রাসায়নিক-মস, লিচেন, শ্যাওলা ইত্যাদি উদ্ভিদ পচে গলে হিউমাসের সৃষ্টি হয়। হিউমাসের উপর বৃষ্টির জল পড়লে হিউমিক অ্যাসিড বা জৈব অ্যাসিড উৎপন্ন হয় যা শিলার আবহবিকারে সাহায্য করে। এছাড়া নানারকম জীবজন্তুর পচা দেহ ও বিষ্ঠা আবহবিকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

(১১) আবহবিকার ও জলবায়ুর সম্পর্ক লিখ।

উত্তর -কোনো অঞ্চলে কি ধরনের আবহবিকার সংঘটিত হবে তা নির্ভর করে জলবায়ুর উপর।তাই বিভিন্ন জলবায়ু অঞ্চলে বিভিন্ন রকম আবহবিকার পরিলক্ষিত হয়। যথা-

(১) উষ্ণ মরু অঞ্চল ও শীতপ্রধান অঞ্চলে যান্ত্রিক আবহবিকার, নিরক্ষীয় জলবায়ু অঞ্চলে রাসায়নিক আবহবিকার, (২) নাতিশীতোষ্ম তৃণভূমি ও সরল বর্গীয় অরণ্য অঞ্চলে জৈবিক আবহবিকার লক্ষ্য করা যায়। (৩) তুন্দ্রা অঞ্চল ও মেরু অঞ্চলে অত্যধিক শৈত্যের জন্য কোন রকম আবহবিকার সংঘটিত হয় না।

(১২) আবহবিকারের ফলাফল ব্যক্ত করো।

উত্তর -আবহবিকারের ফলাফল (Effects of weathering) :

(১) আবহবিকার মৃত্তিকা গঠনে সাহায্য করে।

(২) চূর্ণ-বিচূর্ণ শিলাখণ্ড ভূ-ত্বকের উপর ভূ-আস্তরণ বা রেগোলিথ (Regolith) সৃষ্টি করে।

(৩) ক্ষয় ও অপসারণ প্রক্রিয়া সহজতর হয়।

(৪) শিলাস্তরে ভৌমজল সঞ্চিত হয়।

(৫) মৃত্তিকার বড় বড় ঢেলা ভেঙ্গে গিয়ে চাষযোগ্য জমিতে পরিণত হয়।

(৬) আবহবিকার ভূমিরূপের পরিবর্তন ঘটায়।

(৭) বিভিন্ন প্রকার খনিজ যথা – বক্সাইট, জিপসাম, কেওলিন নিকেল ইত্যাদি গঠিত হয়।

(৮) দ্রবীভূত খনিজ পদার্থ উদ্ভিদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের যোগান দেয়।

(১৩) যান্ত্রিক আবহবিকার ও রাসায়নিক আবহবিকারের পার্থক্য লেখ।

বিষয়   যান্ত্রিক আবহবিকার  রাসায়নিক আবহবিকার
প্রক্রিয়া    প্রাকৃতিক বা যান্ত্রিক পদ্ধতিতে শিলা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।  বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ায় অর্থাৎ রাসায়নিক পদ্ধতিতে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়।                                                                                                                                                    
সনাক্তকরণ  সাধারণভাবে শিলার প্রকৃতি জানা যায়।রাসায়নিক বিশ্লেষণ ছাড়া মূল শিলার প্রকৃতি জানা যায় না।
প্রভাবিত অঞ্চলউষ্ণ মরু অঞ্চল ও পার্বত্য অঞ্চলে

বেশি দেখা যায়।

উষ্ম ও আর্দ্র নিরক্ষীয় জলবায়ু এবংক্রান্তীয় মৌসুমী জলবায়ু অঞ্চলে

রাসায়নিক আবহবিকার অধিক লক্ষ্যকরা যায়।

উপাদানআবহাওয়ার বিভিন্নউপাদান,

উদ্ভিদ ও জীবজন্তু যান্ত্রিক

আবহবিকারে সাহায্য করে।

অক্সিজেন, কার্বন ডাই অক্সাইড,জল,মৃত উদ্ভিদ ও প্রাণী রাসায়নিক

আবহবিকারে সাহায্য করে

                                                                                                         

|

Leave a Comment