আবর্তন বা আহ্নিক গতি (Rotation or Diurnal Motion)

ভূমিকা (Introduction): সূর্যকে পূর্বদিকে উঠতে এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যেতে দেখে প্রাচীনকালের মানুষ মনে করত পৃথিবী স্থির এবং সূর্য গতিশীল। বিখ্যাত গ্রীক জ্যোতির্বিজ্ঞানী টলেমি (Ptolemy) পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা প্রচার করেন। এইধারণায় বলা হয় স্থির পৃথিবীকে কেন্দ্র করে সূর্য ও অন্যান্য জ্যোতিষ্ক পরিক্রমণ করছে।১৭৮ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণার জন্ম হয়। আর্যভট্ট, কোপারনিকাস, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করলেন সূর্য স্থির এবং তাকে কেন্দ্র করে পৃথিবী সহ অন্যান্য জ্যোতিষ্ক পরিক্রমণ করছে। ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী আর্যভট্ট সর্বপ্রথম ঘোষণা করলেন মহাশূন্যে পৃথিবী স্থির অবস্থায় নেই। এর দুটি গতি আছে – (1) আবর্তন গতি বাআহ্নিক গতি (২) পরিক্রমণ গতি বা বার্ষিক গতি।

                                              আবর্তন গতি বা আহ্নিক গতি

প্রশ্ন-(১) আবর্তন বা আহ্নিক গতি (Rotation or Diurnal Motion) কাকে বলে ?

উত্তর–আবর্তন গতি (Rotation) : সুমেরু ও কুমেরু বিন্দুকে একটি কাল্পনিক রেখা দিয়ে যোগ করলে যে রেখা পাওয়া যায় তাকে পৃথিবীর অক্ষ (Axis) বা মেরু রেখা বলে।এই মেরুরেখাকে সামনে রেখে পৃথিবী অনবরত পশ্চিমদিক থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। একে আবর্তন গতি বলে। নিজের চারদিকে একবার আবর্তন করতে পৃথিবীর মোট সময় লগে ২৪ ঘণ্টা বা ১ দিন। তাই আবর্তন গতির অপর নাম দৈনিক গতি। এই গতির ফলে দিন-রাত্রি সংঘটিত হয়। তাই একে আহ্নিক গতি বলা হয়। (অহ্ন = দিন

প্রশ্ন-(•২) পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগের পরিচয় দাও ।

 উত্তর–আবর্তন গতিবেগ : পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগ সর্বত্র সমান নয়। নিরক্ষীয় অঞ্চলে পৃথিবীর আবর্তন বেগ সবচেয়ে বেশি। কারণ এই অঞ্চলের পরিধি সর্বাধিক।এখানে পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগ ঘণ্টায় ১৭০০ কিমি.। নিরক্ষরেখা থেকে যতই উত্তরে কিংবা দক্ষিণে যাওয়া যায়, পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগ ততই কমতে থাকে।কারণ পৃথিবীর পরিধি ক্রমশ কমে যায়।ক্রান্তীয় অঞ্চলে আবর্তন বেগ ঘন্টায় ১৫০০ কি.মি. এবং মেরুবৃত্ত প্রদেশে ঘণ্টায় ৯৯০ কিমি.। উভয় মেরু অঞ্চলে পৃথিবীর আবর্তন গতিবেগ একেবারেই অনুভব করা যায় না।

প্রশ্ন-(৩)গড় সৌরদিন এবং নাক্ষত্রদিন(Mean solar and sideral day):কাকে বলে ?

উত্তর–মধ্যাহ্ন সূর্যের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর আবর্তনের গড় সময়কে সৌরদিন বলে। সৌরদিনের সময়সীমা ২৪ ঘন্টা। ল্যাটিন শব্দ ‘Sidus(সাইডাস) কথার অর্থ নক্ষত্র। সূর্য ছাড়া অন্য কোন নক্ষত্রের পরিপ্রেক্ষিতে পৃথিবীর আবর্তনের সময় সীমাকে নাক্ষত্রদিন বলে। নাক্ষত্রদিনের সময় ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪সেকেন্ড। নাক্ষত্রদিন অপেক্ষা সৌরদিন ৩ মিনিট ৫৬ সেকেণ্ড বেশি।

প্রশ্ন-(৪) পৃথিবীর আবর্তন গতি বুঝতে না পারি না কেন ?

উত্তর- পৃথিবীর আবর্তনগতি বুঝতে না পারার কারণ : আমরা পৃথিবীতে বসবাস করা সত্ত্বেও পৃথিবীর আবর্তন অনুভব করতে পারি না। কারণ (১) পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় আমরা অতি ক্ষুদ্র। (২) পৃথিবীর সবকিছু অর্থাৎ গাছপালা, ঘরবাড়ি, মানুষ প্রভৃতি একই  সঙ্গে    আবর্তন করছে।   (৩) পৃথিবীর প্রতিটি স্থানের আবর্তন গতিবেগ সুনির্দিষ্ট স্থায়ী ও অপরিবর্তনশীল (৪) বায়ুমণ্ডলও পশ্চিম থেকে পূর্বে পৃথিবীর সঙ্গে আবর্তন করছে।

প্রশ্ন-(৫) সূর্যের আপাত  দৈনিক গতি (Sun’s diurnal apparent Motion)কাকে বলে?

উত্তর- সূর্যের দৈনিক আপাত গতি (Sun’s diurnal apparent Motion ) পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য আপাত দৃষ্টিতে মনে হয়, সূর্য প্রতিদিন পূর্ব আকাশে ওঠে এবং পশ্চিম আকাশে অস্ত যায়। একে সূর্যের দৈনিক আপাত গতি বলে। 

         চিত্র-   সূর্যের আপাত  দৈনিক গতি

প্রশ্ন-(৬) প্রমাণ করো পৃথিবীর আবর্তন গতি আছে।

উত্তর-

(১) দিন-রাত্রি সংঘটন (Formation of days and night) ——-পৃথিবীতে সংঘটিত দিন-রাত্রি থেকে স্পষ্ট হয় যে পৃথিবীর আবর্তন গতি আছে।

(২) নিউটনের সূত্র (Law of Gravitation) ——– নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী অপেক্ষাকৃত হাল্কা ও ছোট বস্তুই ভারী বস্তুর চারদিকে পরিক্রমণ করে। সূর্য পৃথিবী অপেক্ষা প্রায় ১৩ লক্ষ গুণ বড় ও প্রায় ৩ লক্ষ গুণ ভারী। সুতরাং পৃথিবীর পক্ষে সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণ করাই স্বাভাবিক।

(৩) অন্যগ্রহ পর্যবেক্ষণ বা প্রত্যক্ষ প্রমাণ (Direct proof): দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে অন্যান্য গ্রহকে নিজ নিজ মেরুরেখার চারদিকে আবর্তন করতে দেখা যায়। সুতরাং পৃথিবীর পক্ষেও এটি স্বাভাবিক ব্যাপার।

(৪) পৃথিবীর অভিগত গোলক আকৃতি (Earth Shape as oblate spheriod)—-

পৃথিবীর অভিগত গোলাকৃতি প্রমাণ করে যে, পৃথিবী আবর্তন করছে। এ কারণেই পৃথিবীর মেরুদ্বয় কিঞ্চিত চাপা এবং নিরক্ষীয় প্রদেশ সেই তুলনায় স্ফীত হয়েছে।

(৫) জোয়ার ভাটা সৃষ্টি (Formation of Tides) :

                                                              চিত্রঃ জোয়ার ভাটা

 চন্দ্রের আকর্ষণে সমুদ্র ও নদীতে প্রত্যহ দুবার জোয়ার ও দুবার ভাটা হয়। চন্দ্র ২৭ দিনে পৃথিবীকে একবার প্রদক্ষিণ করে। পৃথিবীর আবর্তন গতি না থাকলে ২৭ দিন অন্তর জোয়ার ভাটা হত। প্রত্যহ নয়।

(৬) নিয়ত বায়ুপ্রবাহের গতিবিক্ষেপ (Deflection of planetary winds):

ফেরেলের সূত্রানুসারে নিয়তবায়ু উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে অগ্রসর হয়। নিয়ত বায়ুপ্রবাহের এই গতিবেগ থেকে ধারণা পাওয়া যায় যে, পৃথিবীর আবর্তনগতি আছে। পৃথিবীর আবর্তন গতি না থাকলে বায়ু সোজাপথে এগিয়ে যেত।

                                      চিত্র;-নিয়ত বায়ুপ্রবাহের গতিবিক্ষেপ 

(৭) শান্ত বায়ুতে উঁচুস্থান থেকে প্রস্তরখণ্ড নিক্ষেপ : বায়ু শান্ত অবস্থায় উঁচু থেকে কোন প্রস্তরখণ্ড নিচে ফেললে দেখা যায় যে, প্রস্তরখণ্ডটি যেখানে পড়ার কথা সেখানে না পড়ে, সামান্য পূর্বদিকে এগিয়ে পড়ছে। এর থেকে স্পষ্ট হয় যে, পৃথিবীর আবর্তন গতি আছে।

(৮) ফুঁকোর পরীক্ষা (Experiment of Foucault): ১৮৫১ সালে কর বিজ্ঞানী ফুঁকো প্যারিস শহরের প্যান্থিয়ান  গীর্জার চূড়া (৬১ মিটার উঁচু) থেকে এক দোলক ঝুলিয়ে পরীক্ষা করে পৃথিবীর আবর্তনগতির স্বপক্ষে যুক্তি প্রদান করেন। তিি একটি সরু তারের শেষপ্রান্তে একটি ভারী দোলক ও দোলকের নিচে পিন আটকে দেন।দোলকের নিচে জমির উপর এমনভাবে কিছু বালি ছড়ানো ছিল যাতে দোপক সংলগ্ন পিনের অগ্রভাগ জমির উপর ছড়ানো বালিতে অতি সহজেই দাগ কাটতে পারে। তিনি দোলকটি উত্তর-দক্ষিণে দুলিয়ে লক্ষ্য করলেন যে,দোলকটি নির্দিষ্ট গতিতে অনবরত ঘুরছে এবং দোলক সংলগ্ন পিনের অগ্রভাগ মাটিতে ছড়ানো বালির উপর যে দাগ কাটছে তা  এক স্থানে  না কেটে  পশ্চিম থেকে পূর্বে সরে সরে দাগ কাটছে। এর থেকে প্রমাণিত হয়। যে পৃথিবীর আবর্তন গতি আছে।

প্রশ্ন-((৭)আবর্তনগতির ফলাফল (Effects of Rotation)লিখ ।

উত্তর-পৃথিবীর আবর্তন বা  আহ্নিকগতির ফলে নানা ঘটনা ঘটে। যথা

(১) দিন-রাত্রি সংঘটন (Formation of Days and Night) : পৃথিবীর আবর্তন গতির ফলে ভূ-পৃষ্ঠে দিন-রাত্রির আগমন ঘটে। পৃথিবীর এক অর্ধাংশে দিন ও অপর অর্ধাংশে রাত পর্যায়ক্রমিক ভাবে চলতে থাকে। এসময় বিশেষ কতকগুলি অবস্থার সৃষ্টি হয়। যথা : প্রভাত, ঊষা, মধ্যাহ্ন গোধূলি, সন্ধ্যা, মধ্যরাত্রি।

• ছায়াবৃত্ত (Shadow circle) :যে বৃত্তাকার সীমারেখায় দিন ও রাত্রির সীমানা মিলিত  হয়, তাকে ছারাবৃত্ত বা আলোকবৃত্ত বলে।

প্রভাত (Morning) : পৃথিবীর ক্রম আবর্তনের ফলে যখন কোন স্থান অন্ধকার থেকে ছায়াবৃত্ত পার হয়ে সবেমাত্র আলোকিত অংশে পৌঁছে যায় তখন সেখানে প্রভাত হয়।

• ঊষা (Dawn): প্রভাত হওয়ার আগে অর্থাৎ সূর্যোদয়ের পূর্বে বায়ুর ধূলিকণায় সূর্যালোকের সামান্য প্রতিফলনে যে ক্ষীণ আলো চোখে পড়ে তাকে ঊষা বলে।

● মধ্যাহ্ন (Noon) : যখন কোন স্থানে সূর্য ঠিক মাথার উপর থাকে, তখন সেখানে  মধ্যাহ্ন হয়।

● গোধূলি (Dusk): সূর্যাস্তের সময় অর্থাৎ সন্ধ্যা হবার আগে আকাশে যে ক্ষীণ আলো দেখা যায় তাকে গোধূলি সময় বলে। এসময় রাখাল বালকেরা গরুর পাল চারণক্ষেত্র থেকে ঘরে নিয়ে যায়। গোরুগুলির চলার বেগে ভূ-পৃষ্ঠ থেকে ধূলিকণা উপরে উৎক্ষিপ্ত হয়। তাই এই সময়কে গোধূলি বলে।

সন্ধ্যা (Evening) : পৃথিবীর ক্রম আবর্তনের ফলে যখন কোন স্থান আলোকিত অংশ থেকে ছায়াবৃত্ত পার হয়ে অন্ধকার অংশে এসে পৌঁছায় তখন সেখানে সন্ধ্যা হয়।

• মধ্যরাত্রি (Midnight): পৃথিবীর যে স্থানে মধ্যাহ্ন হয়, ঠিক তার বিপরীত স্থানে মধ্যরাত্রি হয়।

• (২) জোয়ার ভাঁটা সৃষ্টি (Formation of Tide) : পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য কেন্দ্রমুখী এবং কেন্দ্রবহিমুখী শক্তির সৃষ্টি হয়। চন্দ্রের আকর্ষণে যেমন জোয়ার-ভাটা সৃষ্টি হয়, তেমনি পৃথিবীর কেন্দ্র বহির্মুখী বা বিকর্ষণশক্তির ফলে সমুদ্র ও নদীতে জোয়ার -ভাটা হয়।

• (৩) নিয়তবায়ুপ্রবাহ ও সমুদ্রস্রোতের গতিবিক্ষেপ (Deflection of planetary winds and ocean currents) : পৃথিবীর আবর্তনগতির ফলে বায়ু ও সমুদ্রস্রোত সোজাপথে অগ্রসর না হয়ে ফেরেলের সূত্রানুসারে উত্তর গোলার্ধে ডানদিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে বামদিকে বেঁকে এগিয়ে যায়।

● (8) দিক নির্ণয় (Determination of side) : পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য সূর্য পূর্বদিকে উঠে এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যায়। ফলে সূর্যকে লক্ষ্য করে পূর্ব ও পশ্চিম দিক্ নির্ণয় করতে পারি। পূর্ব-পশ্চিম দিক্ ঠিক হয়ে গেলে উত্তর-দক্ষিণ দিক্ সহজেই নির্ণয় করা যায়।

● (৫) সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত (Sunrise and sunset) : পৃথিবী আবর্তন করে বলে মনে হয় সূর্য পূর্বদিকে উঠে এবং পশ্চিমদিকে অস্ত যায়।

● (৬) উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের উপর প্রভাব (Influence of vegetation and animals) :পৃথিবীর আবর্তন গতির জন্য উদ্ভিদ ও প্রাণী সৃষ্টির ভৌগোলিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।

• (৭) পৃথিবীর চৌম্বকত্ব -পৃথিবী বিরাট একটি চুম্বক। বিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর আবর্তনগতির জন্যই চৌম্বকত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।

● (৮) স্থানীয় সময়ের পার্থক্য (Differentiation of local time) : পৃথিবীর আবর্তনগতির জন্য প্রতিটি দ্রাঘিমারেখা সূর্যের সম্মুখে আসে। ফলে স্থানীয় সময়ের পার্থক্য দেখা যায়।

Leave a Comment