ভারতের ভূপ্রকৃতি (Relief of India)Long Question

ভারতের ভূপ্রকৃতি (Relief of India)

ভূ-প্রকৃতি অনুসারে ভারত কে কয় ভাগে ভাগ করা যায় ও কি কি? যে কোনো একটি ভাগের  বর্ণনা দাও।

● ভূমিকা (Introduction) : ভারত একটি বৈচিত্র্যময় দেশ। এর ভূ-প্রকৃতি সর্বত্র সমান নয়। কোথাও সুউচ্চ পর্বতমালা, কোথাও কংকময় মালভূমি, আবার কোথাও উর্বর পাললিক সমভূমি। ভূ-প্রকৃতি অনুসারে ভারতকে ৮টি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা

(১) উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল

 (২) উত্তর-পূর্ব পার্বত্য অঞ্চল ও মেঘালয় মালভূমি,

 (৩) সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি (৪) ভারতীয় মরুভূমি

(৫) মধ্য ভারত ও পূর্বের উচ্চভূমি,

(৬) দাক্ষিণাত্য মালভূমি,

(৭) উপকূলের সমভূমি এবং

৮) দ্বীপসমূহ।

Relief of India

■ ১। উত্তরের পার্বত্য অঞ্চল (Northern Mountain ous Region) :

উত্তরের পার্বত্য অঞ্চলকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

 (ক) হিমালয় পর্বত শ্রেণি,

 (খ) লাডাক পর্বতশ্রেণি,

 (গ) কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি।

•                        

(ক) হিমালয় পর্বতশ্রেণি (The Himalayan Mountain Ranges) :

হিমালয় শব্দটির অর্থ হিমের আলয় বা তুষারাবাস। অত্যধিক উচ্চতার জন্য হিমালয় পর্বতের অধিকাংশ স্থান তুষারে ঢাকা থাকে। পৃথিবীর উচ্চতম পর্বতশ্রেণি হিমালয় ভারতের উত্তরে প্রাচীরের ন্যায় দণ্ডায়মান।

পামীরগ্রন্থি থেকে বের হয়ে পশ্চিমে নাঙ্গা পর্বত থেকে পূর্বে নামচা বারোয়া পর্যন্ত প্রসারিত এই ভঙ্গিল পর্বতশ্রেণির দৈর্ঘ্য ২৫০০ কি.মি. এবং প্রস্থ ১৫০-৪০০ কি.মি.।

আজ থেকে ৭ কোটি বছর পূর্বে টার্সিয়ারীযুগে ‘টেথিস’ নামক মহীখাতে (Geosyncline) সঞ্চিত পাললিক শিলাস্তরে গন্ডোয়ানাল্যান্ড ও আঙ্গারাল্যান্ডের পার্শ্বচাপে এই ভঙ্গিল পর্বতমালার সৃষ্টিহয়। বিভিন্ন উচ্চতাবিশিষ্ট কতকগুলি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণির সমষ্টি হল হিমালয়।

  হিমালয়ের ভূ-প্রকৃতি (Himalayan Relief) –

হিমালয়ের ভূ-প্রকৃতি বন্ধুর ও পর্বত সংকুল। সুউচ্চ পর্বতশৃঙ্গ, গভীর উপত্যকা, উচ্চমালভূমি, সংকীর্ণ গিরিখাত, গিরিপথ, বন্ধুর শৈলশিরা, হিমবাহ, হ্রদ প্রভৃতির সমারোহ দেখতে পাওয়া যায়।পর্বত গাত্র বনভূমি ও শিখরদেশ তুষারে ঢাকা। কোথাও কোথাও জলপ্রপাত দেখা যায়।শ্রেণিবিভাগ – উত্তর-দক্ষিণে চারটি সমান্তরাল পর্বতশ্রেণিতে হিমালয়কে ভাগ করা যায়।যথা-

(১) টেথিস বা টান্স হিমালয় : সবচেয়ে উত্তরে টেথিস হিমালয় তিব্বতে মিশে গিয়েছে। এর গড় উচ্চতা ৫০০০-৬০০০ মিটার। জম্মু ও কাশ্মীরের জাস্কর পর্বতের অন্তর্ভূক্ত।

(২) হিমগিরি বা হিমাদ্রি : টেথিস হিমালয়ের দক্ষিণে হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয় অবস্থিত। গড় উচ্চতা ৬০০০ মিটারের বেশি। মাউন্ট এভারেস্ট (পৃথিবীর সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, ৮৮৪৮ মিটার), কাঞ্চনজঙ্গা, (পৃথিবীর তৃতীয় উচ্চতম  শৃঙ্গ  ৮৫৯৮), মাকালু(৮৪৮১), ধবলগিরি (৮,১৭২ মি.) মানাসলু (৮১৫৬ মি.) নাঙ্গা (৮১২৬ মি.) অন্নপূর্ণা(৮০৭৮মি.) নন্দাদেবী (৭৮১৭ মি.), নামচাবারোয়া (৭,৭৫৬ মি.) প্রভৃতি উচ্চ শৃঙ্গ এবং জোজিলা, বরাচালা, বুর্জিলালা ইত্যাদি গিরিপথ এখানে অবস্থিত

(৩) হিমাচল বা অবহিমালয়– হিমাদ্রির দক্ষিণে হিমাচল বা অবহিমালয় বা মধ্য হিমালয় অবস্থিত। গড় উচ্চতা ৪০০০ মিটার। এখানে পির পাঞ্জাল,ধাওলাধর, নাগটিব্বা পর্বত, দুন, মারি, কাংড়া প্রভৃতি উপত্যকা এবং বুন্দিল, পীর,বানিহাল, প্রভৃতি গিরিপথ (passes) দেখা যায়। শ্রীনগর, মুসৌরী, ডালহৌসী,ল্যান্সডাউন, দার্জিলিং, ইত্যাদি বিখ্যাত শৈলনিবাস এই অঞ্চলের অন্তর্গত

(৪) নিম্ন হিমালয় বা শিবালিক : হিমালয়ের সর্ব-দক্ষিণে নিম্ন হিমালয় বা শিবালিক অবস্থিত। গড় উচ্চতা ১০০০ মিটার। এর পাদদেশে তরাই অঞ্চল অবস্থিত

• হিমালয়ের হিমবাহ (Himalayan Glaciers): গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী,কেদারনাথ, কাঞ্চনজঙ্ঘা ইত্যাদি।

• হিমালয়ের হ্রদ ও প্রস্রবণ (Himalayan lakes, springs) : ডাল, উলার,বাসুকিনাথ, হেমকুন্ড, রূপকুন্ড ইত্যাদি হিমালয়ের অন্যতম হ্রদ, অনন্তনাগ, ভেরনাগ এবং মুসৌরী,প্রভৃতি অন্যতম প্রস্রবণ।

• হিমালয়ের উপত্যকা (Himalayan Valley) : দুটি পর্বত বা পর্বতশ্রেণির মাঝখানে অবস্থিত সংকীর্ণ ভূ-ভাগকে উপত্যকা বলে। পীরপঞ্জাল ও জাস্কর পর্বতেরমাঝখানে কাশ্মীর উপত্যকা, পীরপঞ্জাল ও ধাওলাধরের মাঝখানে কুলু উপত্যকা,ধাওলাধর ও শিবালিকের মাঝখানে কাংড়া উপত্যকা, ধাওলাধর ও নাগটিব্বার  মাঝখানে শতদ্রু উপত্যকা ইত্যাদি হিমালয়ের অন্যতম উপত্যকা। এগুলির মধ্যে কাশ্মীর উপত্যকার সৌন্দর্য এত মনোরম যে, একে পৃথিবীর স্বর্গ বা ভূ-স্বর্গ বলা হয়।

• (খ) লাডাক পর্বতশ্রেণি (Iadakh Range) : হিমাদ্রি বা প্রধান হিমালয়ের উত্তরে প্রায় ৩৫০ কি.মি. দীর্ঘ লাডাক পর্বতশ্রেণি অবস্থিত। হিমালয় পর্বত সৃষ্টির সময়েই এর উত্থান ঘটে। ভারতের সর্বোচ্চ মালভূমি লাডাক এই অংশে অবস্থিত।

 • (গ) কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি (Karakoram Range) : লাডাকের উত্তরে প্রায় ৪০০ কি.মি. বিস্তৃত কারাকোরাম পর্বতশ্রেণি অবস্থান করছে। পৃথিবীর দ্বিতীয় উচ্চতম  এবং ভারতের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ গডউইন অস্টিন (K, ৮,৬১১ মি.)কারাকোরাম পর্বতশ্রেণিতে অবস্থিত। এখানকার শৃঙ্গগুলি সারাবছর তুষারাবৃত থাকে বলে এই পর্বতশ্রেণিকে বসুধা বা ধবলশীর্ষ বলা হয়। কারাকোরামের  উল্লেখযোগ্য হিমাহগুলি হল সিয়াচেন, বলটারো, রিমো প্রভৃতি। সিয়াচেন (৮০ কি.মি) ভারতের দীর্ঘতম হিমবাহ।

• হিমালয়ের আঞ্চলিক বিভাগ (Regional Divisions of Himalayas):

আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী হিমালয় পর্বতশ্রেণিকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

i) পশ্চিম হিমালয় -জম্মু-কাশ্মীর, হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাঞ্চলের পার্বত্যঅংশ নিয়ে পশ্চিম হিমালয় গঠিত। পশ্চিমে নাঙ্গাপর্বত থেকে পূর্বে উত্তরাঞ্চল এবং নেপাল সীমান্তে অবস্থিত কালী নদী পর্যন্ত পশ্চিম হিমালয় বিস্তৃত।

(ii) মধ্যহিমালয় : পশ্চিমে কালী নদী থেকে নেপাল ও ভারতের সিকিম রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি পর্যন্ত মধ্য হিমালয় বিস্তৃত রয়েছে।

(iii) পূর্ব হিমালয় — পশ্চিমে সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি থেকে পূর্বে ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশের নামচাবারোয়া পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চল পূর্ব হিমালয় নামে পরিচিত। এটি চারভাগে বিভক্ত। যথা –(ক) সিকিমে সিকিম হিমালয়, (খ) পশ্চিমবঙ্গে দার্জিলিং হিমালয় (গ) ভূটানে ভূটান হিমালয় (ঘ)অরুণাচল প্রদেশে অরুণাচল প্রদেশ হিমালয়।

• হিমালয়ের গুরুত্ব ঃ ভারতীয় উপমহাদেশের কাছে হিমালয়ের অবস্থান দেবতার

আশির্বাদস্বরূপ। মানব-জীবনকে হিমালয় নানাভাবে সাহায্য করছে –

 (১)অতন্দ্রপ্রহরীর ন্যায় ভারতবর্ষকে বৈদেশিক শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করছে।

 (২) উত্তরের শীতল কনকনে বায়ু প্রবেশ করতে পারে না।

(৩) দঃপঃ মৌসুমী বায়ু হিমালয়ে প্রতিহত হয়ে। ভারতে বৃষ্টিপাত ঘটায়।

 (৪) বরফ গলা জলে অনেক নদীর সৃষ্টি হয়েছে।

 (৫) হিমালয় পর্বতে মূল্যবান বনজ সম্পদ পাওয়া যায়।

 (৬) হিমালয়ের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য,স্বাস্থ্যকর জলবায়ু ভারতকে পর্যটন শিল্প ও স্বাস্থ্যনিবাস গড়ে তুলতে সাহায্য করছে।

2) সিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি বা উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমির বর্ণনা দাও।

উত্তরসিন্ধু-গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র সমভূমি বা উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি (The Great plains of north India) :

 হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল এবং উপ-দ্বীপীয় মালভূমির মাঝখানে উত্তর ভারতের বিশাল সমভূমি অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ২৫০০ কি.মি,এবং প্রস্থ ২৪০ – ৩২০ কি.মি.। এই সমভূমির আয়তন ৬,৫২,০০০ বর্গকি.মি.।

হিমালয় ও উপদ্বীপীয় মালভূমির মাঝে অবস্থিত অবনমিত অংশে সিন্ধু, গঙ্গা, তাদের উপনদী দ্বারা বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে এই বিশাল সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে হিমালয় ও মেঘালয় মালভূমিরমাঝখানে ব্রক্ষ্মপুত্র নদ ও তার উপনদী দ্বারা বয়ে আনা পলি ভরাট হওয়ার ফলে ব্রহ্মপুত্র সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে। উত্তর ভারতের সমভূমিকে তিনভাগে ভাগ করা যায় –

(১) গাঙ্গেয় সমভূমি 

 (খ) পাঞ্জাব সমভূমি 

এবং(গ) ব্রক্ষ্মপুত্র সমভূমি।

 গাঙ্গেয় সমভূমি : পশ্চিমে যমুনা নদী থেকে পূর্বে বঙ্গোপসাগর উপকূল(সাগরদ্বীপ) পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলকে গাঙ্গেয় সমভূমি বলে। উত্তরাঞ্চল, উত্তরপ্রদেশ,বিহার, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে এই সমভূমি দেখা যায়। গাঙ্গেয় সমভূমি সমতল।কোথাও কোন পাহাড় নেই। কেবলমাত্র উঁচু ঢিবি, স্বাভাবিক বাঁধ, ও ক্ষয়প্রাপ্ত ভূমি দেখা যায়। সমভূমিটির গড় উচ্চতা ১০০-১৫০ মিটার। সমভূমির উত্তরাংশে হিমালয়ের পাদদেশে নুড়ি, কাঁকর, বালি ইত্যাদি বেশি থাকায় এই অংশের মৃত্তিকা বেশ সচ্ছিদ্র। একে ভাবর বলে। এর দক্ষিণে বিস্তীর্ণ অরণ্যময় জলমগ্ন স্যাঁতসেঁতে অঞ্চল তরাই নামে পরিচিত। জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার তরাই ভূমিকে ডুয়ার্স  বলে। সমভূমির প্রাচীন পলিগঠিত তাংশকে ভাঙ্গর (Bhangar)  এবং নবীন পলিগঠিত অংশকে খাদার (Khadar) বলা হয়। ভাঙ্গর অপেক্ষা খাদার উর্বর।

গাঙ্গেয়  সমভূমিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়।

(১) উচ্চগাঙ্গেয় (হরিদ্বার থেকে এলাহাবাদ)

(২) মধ্য গাঙ্গেয় (এলাহাবাদ থেকে রাজমহল) এবং

(৩) নিম্নগাঙ্গেয় (রাজমহল থেকে সাগরদ্বীপ)

• পাঞ্জাব সমভূমি : গাঙ্গেয় সমভূমির পশ্চিমে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লী রাজ্যে এই সমভূমি অবস্থিত। এই সমভূমিটির ঢাল উত্তর-পূর্বদিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। গড় উচ্চতা ২০০ – ২৫০ মিটার। সিন্ধুর উপনদী শতদ্রু, বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা,প্রভৃতি নদী দ্বারা বাহিত পলি সঞ্চয়ের ফলে পাঞ্জাব সমভূমির সৃষ্টি হয়েছে। এখানকার নতুন পলি দ্বারা গঠিত অংশকে পাঞ্জাবে বেট বলে।

• ব্রহ্মপুত্র সমভূমি : গাঙ্গেয় সমভূমির পূর্বদিকে ব্রহ্মপুত্র সমভূমি বা আসাম সমভূমি অবস্থিত। এর দৈর্ঘ্য ৭২০ কি.মি., প্রস্থ ৮০ কি.মি. এবং গড় উচ্চতা পূর্বদিকে১৩০ মিটার, পশ্চিমদিকে ৩০ মিটার। সমভূমিটির আয়তন ৫৬,৫০০ বর্গকি.মি.।সমভূমির বিভিন্ন স্থানে জলাভূমি, অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ, নদী-দ্বীপ বা নদী চর দেখা যায়।ব্রহ্মপুত্র নদের বক্ষে অবস্থিত মাজুলী  ভারতের  বৃহত্তম নদী মধ্যবর্ত্তী দ্বীপ

Leave a Comment